বঙ্গবাণী (আবদুল হাকিম)

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলা সাহিত্য কবিতা | - | NCTB BOOK

কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস ।

সে সবে কহিল মোতে মনে হাবিলাষ ॥

তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।

নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন ৷

আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ ।

দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ ॥

আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত ।

যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত ॥

যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ ।

সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন ॥

সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী ।

বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী ॥

মারফত ভেদে যার নাহিক গমন ।

হিন্দুর অক্ষরে হিংসে সে সবের গণ ॥

যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী ।

সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ॥

দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায় ।

নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায় ॥

মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।

দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি ॥

common.content_added_and_updated_by

কবি পরিচিতি

 আনুমানিক ১৬২০ খ্রিষ্টাব্দে সন্দ্বীপের সুধারামপুর গ্রামে আবদুল হাকিম জন্মগ্রহণ করেন। মধ্যযুগের অন্যতম প্রধান কবি আবদুল হাকিমের স্বদেশের ও স্বভাষার প্রতি ছিল অটুট ও অপরিসীম প্রেম। সেই যুগে মাতৃভাষার প্রতি এমন গভীর ভালোবাসার নিদর্শন ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কালজয়ী আদর্শ। নূরনামা তাঁর বিখ্যাত কাব্য। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্য হলো : ইউসুফ জোলেখা, লালমতি, সয়ফুলমুলক, শিহাবুদ্দিননামা, নসীহত্থামা, কারবালা ও শহরনামা। তাঁর কবিতায় অনুপম ব্যক্তিত্বের পরিচয় মেলে। তিনি ১৬৯০ সালে মৃত্যুবরণ করেন ।

common.content_added_by

শব্দার্থ ও টিকা

হাবিলাষ- অভিলাষ, প্রবল ইচ্ছা। ছিফত- গুণ। নিরঞ্জন- নির্মল (এখানে সৃষ্টিকর্তা, আল্লাহ)।বঙ্গবাণী- বাংলা ভাষা। মারফত - মরমি সাধনা, আল্লাহকে সম্যকভাবে জানার জন্য সাধনা। জুয়ায়- যোগায় । ভাগ- ভাগ্য। দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়- এই কবিতাটি সপ্তদশ শতকে রচিত । তৎকালেও এক শ্রেণির লোক নিজের দেশ, নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতি, এমন কি নিজের আসল পরিচয় সম্পর্কেও ছিল বিভ্রান্ত এবং সংকীর্ণচেতা। শিকড়হীন পরগাছা স্বভাবের এসব লোকের প্রতি কবি তীব্র ক্ষোভে বলিষ্ঠ বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, “নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়'। আপে- স্বয়ং, আপনি ৷

common.content_added_and_updated_by

পাঠ পরিচিতি

বঙ্গবাণী' কবিতাটি কবি আবদুল হাকিমের নূরনামা কাব্য থেকে সংকলন করা হয়েছে। মধ্যযুগীয় পরিবেশে বঙ্গভাষী এবং বঙ্গভাষার প্রতি এমন বলিষ্ট বাণীবদ্ধ কবিতার নিদর্শন দুর্লভ ।
কবি এই কবিতায় তাঁর গভীর উপলব্ধি ও বিশ্বাসের কথা নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করেছেন। আরবি ফারসি ভাষার প্রতি কবির মোটেই বিদ্বেষ নেই। এ সব ভাষায় আল্লাহ ও মহানবীর স্তুতি বর্ণিত হয়েছে। তাই এসব ভাষার প্রতি সবাই পরম শ্রদ্ধাশীল। যে ভাষা জনসাধারণের বোধগম্য নয়, যে ভাষায় অন্যের সঙ্গে ভাববিনিময় করা যায় না সে সব ভাষাভাষী লোকের পক্ষে মাতৃভাষায় কথা বলা বা লেখাই একমাত্র পন্থা। এই কারণেই কবি মাতৃভাষায় গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করেছেন। কবির মতে, মানুষ মাত্রেই নিজ ভাষায় স্রষ্টাকে ডাকে আর স্রষ্টাও মানুষের বক্তব্য বুঝতে পারেন। কবির চিত্তে তীব্র ক্ষোভ এজন্য যে, যারা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে, অথচ বাংলা ভাষার প্রতি তাদের মমতা নেই, তাদের বংশ ও জন্মপরিচয় সম্পর্কে কবির মনে সন্দেহ জাগে। কবি সখেদে বলেছেন, এ সব লোক, যাদের মনে স্বদেশের ও স্বভাষার প্রতি কিছুমাত্র অনুরাগ নেই তারা কেন এদেশ পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায় না! বংশানুক্রমে বাংলাদেশেই আমাদের বসতি, বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষা বাংলায় বর্ণিত বক্তব্য আমাদের মর্ম স্পর্শ করে । এই ভাষার চেয়ে হিতকর আর কী হতে পারে । কবিতায় মাতৃভাষার প্রতি প্রেম ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় ফুটে উঠেছে।

common.content_added_and_updated_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion