সম্প্রদায়

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বই | - | NCTB BOOK

বেদে-কন্যা

সামনে স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া উৎসব। তাই নিয়ে ক্লাসের সবার অনেক জল্পনা-কল্পনা। “আমি তিনশত মিটার দৌড় দেব! আমি খেলব মোরগ লড়াই! হাঁড়ি ভাঙার খেলায় সবচেয়ে বেশি মজা হয়!!”— টিফিনের সময় তুমুল আলোচনা চলছিল।

সালমা: আমি ‘যেমন খুশি তেমন সাজো'তে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সাজব। 

শিহান: আমি সাজব ‘বঙ্গবন্ধু’। আমার দাদুর মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটা পরব। ডান হাতের তর্জনী তুলে সাতই মার্চের ভাষণ দেব। ভাষণটা আমি একটুখানি পারি, আরও ভালো করে শিখে নেব। 

মামুন: আমি সাজব রাখাল ছেলে। মাথায় গামছা বেঁধে বাঁশি বাজাব। আমি বাঁশের বাঁশি বাজাতে পারি। 

মিলি: আমি বেদে-কন্যা সাজব। আমাদের স্কুলে এইটের যে সানজিদা আপু; ওদের বেদে পরিবার। আপু আমাকে সাজিয়ে দেবে বলেছে। 

আদনান: সানজিদা আপুকে বললে আমাকে সাপুড়ে সাজিয়ে দেবে? 

মিলি: আমি বলে দেখব। নিশ্চয়ই দেবে। 

আদনান: আমি তাহলে ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ সাজব। আমার কাছে একটা খেলনা বীণ বাঁশিও আছে। 

সবাই তখন যেমন খুশি তেমন সাজোতে কে কী সাজবে, কেমন করে সাজবে— তাই নিয়ে দারুণ দারুণ সব পরিকল্পনা করতে লাগল। কেউ সাজবে চাকমা মেয়ে, কেউ হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেউ সাজবে আইনস্টাইন, কেউ হবে প্রীতিলতা, কেউ হবে মুক্তিযোদ্ধা। ওরা এই গল্পে এমন মজা পেল যে কখন ক্লাস শুরুর ঘণ্টা পড়ল আর কখন খুশি আপা এসে ক্লাসে ঢুকলেন, ওরা খেয়ালই করল না। 

খুশি আপা: কী এত মজার কথা হচ্ছে? 

হাচ্চা: আমরা খেলার উৎসব নিয়ে কথা বলছিলাম। যেমন খুশি তেমন সাজোতে কে কী সাজবে সেই কথা নিয়ে মজার আলাপ হচ্ছিল। 

খুশি আপা: তাই নাকি! বাহ, দারুণ মজার তো! 

এরপর খুশি আপার কাছে ওরা কে কী সাজবে, কীভাবে সাজবে বিস্তারিত বলতে লাগল। খুশি আপা বললেন, তোমরা তো অসাধারণ সব পরিকল্পনা করেছ! তিনি যখন জানলেন, মিলি বেদে-কন্যা সাজতে চায়, তখন বললেন, আমাদের এলাকায় কয়েক দিন হলো একটা বেদের বহর এসেছে। আনাই বলল, বেদের বহর মানে কী? খুশি আপা বললেন, আমাদের এলাকার বেদেরা যেমন ঘরবাড়ি বানিয়ে থাকে, সব বেদেরা তেমনভাবে থাকে না। অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে নৌকায় চড়ে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়। ওরা সবাই খুশি আপাকে ধরল, “আমরা বেদের বহর দেখতে যেতে চাই। ”

এক সকালে ওরা খুশি আপার সঙ্গে বেদের বহর দেখতে গেল।

 

দেখে আসি বেদে বহর

খুশি আপার সঙ্গে সবাই নদীর দিকে গেল। নদীর তীর ঘেঁষে সারি সারি নৌকার যেন মেলা বসেছে। নৌকায় আর তীরে নানান বয়সী অনেক মানুষ। ওরা হেঁটে হেঁটে দেখতে লাগল। 

একটি মেয়ে ওদের দিকে এগিয়ে এলো। খুশি আপার কাছে জানতে চাইল, কাউকে খুঁজছেন?” 

খুশি আপা: আমরা তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হতে এসেছি। তোমাদের সর্দারের সঙ্গে গতকাল আলাপ করে গিয়েছিলাম। 

মেয়ে: আসুন, আপনাদের সর্দারের কাছে নিয়ে যাই। 

মেয়েটির সাথে সবাই বেদে সর্দারের কাছে গেল। খুশি আপা সর্দারের সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।

গণেশ: আগে কখনও আপনাদের দেখিনি। আপনাদের বাড়ি কি অনেক দূরে? 

সর্দার: এই নৌকাই আমাদের ঘর। এখানে যে পঁচিশ পরিবারের মানুষ, তাদের নিয়ে আমাদের বাড়ি। আমরা নিজেদের ঘরবাড়ি নিয়ে সারা বছর নদীতে ঘুরে বেড়াই। কিছুদিন এক জায়গায় থাকি আবার নতুন জায়গায় চলে যাই । 

আয়েশা: দারুণ মজার তো! কত দিন ধরে আপনারা নৌকায় থাকছেন? 

সর্দার: কত শত বছর ধরে যে আমরা নৌকায় থাকি, কেউ সেটা ঠিক করে বলতে পারে না। আমার জন্ম এই নৌকায়, আমার বাপ-মায়েরও জন্ম নৌকায়, তাঁদের বাবা-মাও নৌকায়ই জন্মেছিলেন। কেউ বলে যাযাবর জীবনের আগে আমরা মিয়ানমারে থাকতাম, কেউ বলে ভারতে। কেউ আবার বলে, এদেশের সাঁওতালরা আমাদের পূর্ব পুরুষ

ফ্রান্সিস: ঝড়-বৃষ্টি হলে আপনাদের নিশ্চয়ই খুব অসুবিধা হয়! আবার যখন বৃষ্টি হয় না, নদীতে পানি কম | থাকে, তখনও অসুবিধা হয়। তবু এ রকম নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর জীবন অন্য রকম আনন্দের। | 

সর্দার: কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ। নৌকার জীবনে আনন্দও আছে, কষ্টও আছে। কিন্তু শত শত বছর ধরে | আমরা নৌকায় থাকছি, আর এদিকে ডাঙার পৃথিবী কত বদলে গিয়েছে! আমাদের অনেকেই এখন বেদে | জীবন ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে, অনেকে আবার নৌকা ছেড়ে ডাঙায় থাকতে শুরু করেছে। 

মামুন: এদেশে কি আপনাদের মতো আরও বেদে আছে? | 

সর্দার: নিশ্চয়ই। কতজন আছে সেই হিসাব অবশ্য আমি জানি না। তবে কয়েক লাখ তো হবেই। 

খুশি আপা: খবরের কাগজে পড়েছিলাম, বাংলাদেশে প্রায় আট লক্ষ বেদে আছে। তবে তাদের সবার জীবন এক রকম না। | 

সর্দার: আপনি ঠিকই বলেছেন, আপা। বেদেরা সবাই নৌকায় থাকে না। সবার কাজও এক রকম না। আমরা সাপ ধরি, সাপের খেলা দেখাই, নানা রকম ওষুধ, তাবিজ বিক্রি করি। 

আমাদের বলে ‘সাপুড়ে’। ‘গাইন’ বেদেরা সুগন্ধি মসলা বিক্রি করে। আবার ‘শানদার’ বেদেরা আছে যারা মেয়েদের চুরি, ফিতা, সাজগোজের জিনিস বিক্রি করে। ‘বাজিকর’ বেদেরা যাদু দেখায়, সার্কাস দেখায়। অন্য বেদেদের কেউ পুকুরে হারানো জিনিস খুঁজে দেয়, কেউবা বানরের খেলা দেখায়, টিয়াপাখি দিয়ে মানুষের ভাগ্য গণনা করে । তবে সকল বেদেই তন্ত্রমন্ত্র, যাদুটোনা জানে । 

মিলি: আমি আপনাদের বহরের মেয়েদের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। 

সর্দার: এতক্ষণে তো বেশির ভাগ মেয়েই বেরিয়ে পড়েছে। আমাদের সমাজের রীতি অনুযায়ী মেয়েদের আয়-রোজগারের কাজে যেতে হয়। বেলা হয়েছে, অনেকেই বেরিয়ে পড়েছে। তবে সবাই এখনও যায়নি। | যারা আছে, চাইলে তাদের যে কারোর সঙ্গে তুমি কথা বলতে পারো। 

রনি: মেয়েরাই কি কেবল রোজগার করে, ছেলেরা করে না? 

সর্দার: আমাদের সমাজের পুরোনো রীতি অনুযায়ী, মেয়েরা বিয়ের সময় বরের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয়। তাই মেয়েরা রোজগার করবে আর ছেলেরা বাচ্চা সামলানো, রান্না-বান্না আর ঘরের কাজের দায়িত্ব | নেবে— এটাই নিয়ম। তবে ছেলেরা মাছ ধরে, জঙ্গল থেকে সাপ ধরে আনে, মাঝে মাঝে সাপের খেলাও দেখায়। এখন অনেকেই আয় রোজগারও করে। 

ফাতেমা: আপনাদের বিয়ের রীতি-নীতি সম্পর্কে আরও কিছু জানতে ইচ্ছে করছে। 

সর্দারের সঙ্গে ওরা যখন গল্প করছিল তখন বেদে দলের অনেকেই আশপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের | মধ্য থেকে একটা ছেলে বলল, বেদেরা নিজেদের সমাজের মধ্যেই বিয়ে করে। এদেশের বেশির ভাগ বেদে মুসলমান, আমরাও। তাই আমাদের বিয়ে মুসলমান রীতিতে হয়। তবে বিয়েতে কোনো নিমন্ত্রণ, খাওয়া- দাওয়া, উপহার দেওয়া-নেওয়া হয় না। বিয়ের সময় আমরা সবাই মিলে নাচগান করি। খুব মজা হয়।

এর মধ্যে একটা ছোট ছেলে ওদের কাছে এসে দাঁড়াল। তার গলায় একটা সাপ পেঁচানো। অন্বেষা আর সুমন | হঠাৎ সাপ দেখে খুব চমকে উঠল। তখন একজন লোক ছেলেটাকে বকতে লাগল, ছেলেটাও কী যেন বলল। কিন্তু এই দুজনের কথাবার্তা ওরা কিছুই বুঝতে পারল না। 

রবিন: ওরা কী বলছে? 

সর্দার: ছেলেটার গলায় সাপ দেখে তোমরা ভয় পেয়েছ বলে, ওর বাবা ওকে বলেছে এভাবে মানুষকে ভয় দেখালে মা মনসা রাগ করবেন। 

রবিন: কিন্তু আমি তো ওদের একটা কথাও বুঝলাম না! 

সর্দার: আমাদের নিজেদের ভাষা হলো ‘ঠার’ ভাষা। ওরা ওই ভাষায় কথা বলেছে বলে তোমরা কিছু বুঝতে পারোনি। 

ওরা আরও কিছুক্ষণ গল্প করল। মিলি ওখানে দাঁড়ানো বেদে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলল।

হঠাৎ একজন বয়স্ক নারী মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলেন। কয়েকজন তাকে ধরে ফেলল। বেদে দলের সবার | মধ্যেই একটা ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। চার-পাঁচজন মিলে তাকে কোলে তুলে রাখল। কেউ পানি আনছে, কেউ বাতাস করছে। একজন নারী বলছেন, তুমি কদিন ধরে এত অসুস্থ! তোমাকে বললাম, নৌকায় শুয়ে থাকতে, আমি একটুখানি দেখেই ফিরে আসছি। তাও কথা শুনলে না! এখন তোমার ছেলে-মেয়েরা কাজ থেকে ফিরে আমাকে কী বলবে বলো তো! সর্দার ভির ঠেলে সামনে এগিয়ে এলেন। সবাইকে শান্ত হয়ে সরে দাঁড়াতে বললেন। ওরা সবাই সর্দারের কথামতো একটু সরে দাঁড়াল, কিন্তু কেউ চলে গেল না। সবার চোখমুখে উৎকণ্ঠা। সর্দার বললেন, “চৌরানি বেগমকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে।” দুজনকে পাঠালেন ভ্যান ডেকে আনতে। আরও দুজনকে বললেন, চৌরানি বেগমের দু'একটা কাপড়, পানি আর শুকনা খাবার নিয়ে আসতে। সবাই ধরাধরি করে ভদ্রমহিলাকে ভ্যানে তুলল। তার সঙ্গে দুজন ভ্যানে চড়ে বসল। আরও দুই-তিনজন ভ্যানটাকে ঠেলে নিয়ে যেতে লাগল। আরও বেশ কিছু মানুষ ভ্যানের পেছন পেছন হেঁটে যেতে লাগল।

শিহান বলল, তাঁর ছেলে-মেয়েকে খবর দিতে হবে না! 

বেদের দলের ওদেরই বয়সী একটা মেয়ে অবাক হয়ে বলল, আমরা এতজন আছি, সর্দার আছেন, ছেলে- মেয়েকে আলাদা করে জানাতে হবে কেন! 

বয়সে বড় আর একটি ছেলে বুঝিয়ে বলল, আসলে আমাদের এখানে সবার সুখ-দু:খই সবাই ভাগ করে | নিই। একজনের বিপদে সবাই এগিয়ে আসে। আমাদের সর্দার সবার অভিভাবক। তিনি আমাদের পরামর্শ, | নির্দেশ দেন, আমরা সেগুলো মেনে চলি। নিজেদের মধ্যে কোনো বিরোধ হলে সর্দারই সালিশ করে মীমাংসা করে দেন। 

ওরা আরও কিছুক্ষণ সেখানে থাকল। ঘুরে ঘুরে নৌকাগুলোর ভেতরেও দেখল। এতটুকু নৌকায় ওদের সংসারের সমস্ত জিনিসপত্র কী সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে! 

বেড়ানো শেষে খুশি আপা ওদের নিয়ে ক্লাসে চলে এলেন।

 

বেদে দলের বৈশিষ্ট্য

ক্লাসে ফিরে খুশি আপা জানতে চাইলেন, আমরা যে বেদের বহর দেখে এলাম তোমাদের কেমন লাগল? 

ওরা জানাল যে, ওদের সবারই খুব ভালো লেগেছে। 

খুশি আপা: কেন ভালো লাগল বলো তো? 

সাবা: বেদে জীবন আমার কাছে দারুণ রোমাঞ্চকর মনে হয়েছে! কেমন ঘরবাড়ি সঙ্গে নিয়ে নদীতে নদীতে সারা জীবন ঘুরে বেড়ায় !

বুশরা: আমরা বছরে দু'একবার বেড়াতে যাই, অথচ ওরা সারা বছর বেড়ায়! 

গৌতম: ওরা যে একজনের বিপদে সবাই ছুটে আসে, যেন এতগুলো মানুষের একটাই পরিবার; এই বিষয়টা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে। 

রূপা: ওদের কী আশ্চর্য সাহস! সাপ ধরে, সাপের খেলা দেখায়! এমনকি ওদের বাচ্চাগুলো পর্যন্ত সাপ নিয়ে খেলছে! 

খুশি আপা: তোমরা তো অনেক কিছু লক্ষ করেছ! তাহলে চলো এবার আমরা বেদের বহরে কী কী উল্লেখযোগ্য বিষয় দেখেছি তার একটা তালিকা তৈরি করি। কাজটি আমরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে করব। 

ওরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে কাজটি করল। কাজ শেষে প্রতিটি দল নিজেদের তালিকা পড়ে শোনাল। একই বিষয় যেখানে একাধিক দলের তালিকায় এসেছে সেগুলোকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হলো। একটি দলের তালিকায় সেটি রেখে বাকি দলগুলো থেকে বাদ দেওয়া হলো। 

এরপর খুশি আপা বললেন, এবার আমরা প্রত্যেকটা বিষয় আলাদা আলাদা কাগজে, সংক্ষেপে, বড় বড় করে লিখব। খুশি আপা প্রতিটি দলকে টুকরো টুকরো রঙিন কাগজ দিলেন। ক্লাসরুমে একটি বড় পোস্টার পেপার টাঙিয়ে দেওয়া হলো। সবার লেখা শেষে সবগুলো দলের লেখা কাগজ পোস্টার পেপারে ওপর থেকে নিচে ধারাবাহিকভাবে সাঁটানো হলো। 

খুশি আপা বললেন, আমরা তালিকায় যে বিষয়গুলো রেখেছি সেগুলো থেকে বেদে দলের কোনো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য কি খুঁজে পাচ্ছি? ওরা বলল, প্রতিটি বিষয় থেকেই বেদে দলের কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। আলোচনার মাধ্যমে বৈশিষ্ট্যগুলোর নাম ঠিক করে প্রতিটি দল তাদের দেখা বিষয়বস্তুর পাশে বৈশিষ্ট্যের নাম লিখে দিয়ে গেল। এভাবে সবগুলো দলের তালিকা একত্র করে একটা নতুন তালিকা তৈরি হলো।

তালিকাটি দেখতে অনেকটা এ রকম হলো ।

যা দেখেছিবৈশিষ্ট্য
পঁচিশটি পরিবারের একটি দলএকদল মানুষ
ওরা নিজেদের ‘বেদে' হিসেবে পরিচয় দেয়স্বকীয়তার বোধ
একের সমস্যাকে সবার সমস্যা হিসেবে দেখে, একসঙ্গে সমাধান করেএকাত্মতার বোধ
নিজেদের মধ্যে আলাদা ভাষায় কথা বলে। সবাই বাংলা ভাষাও বলতে পারে 
  
  
  
  
  

 

সম্প্রদায়

তালিকা তৈরি শেষ করে খুশি আপা বোর্ডে ‘সম্প্রদায়' কথাটা লিখলেন। তারপর বললেন, আমরা এতক্ষণ বেদে দলের যে বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজে পেলাম, মানুষের কোনো দলের মধ্যে যদি এ ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তাহলে আমরা সেই দলটাকে একটা ‘সম্প্রদায়' বলি।

মাহবুব: তাহলে তো আমরা বেদেদের একটা ‘সম্প্রদায়' বলতে পারি।

খুশি আপা: অবশ্যই পারি। বেদেদের মতো আমরাও প্রত্যেকে কোনো না কোনো সম্প্রদায়ের সদস্য। একজন মানুষ অনেকগুলো সম্প্রদায়ের সদস্য হতে পারে। তবে জেনে রাখি:

বেদে সম্প্রদায়ের যে বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা দেখেছি, অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে তার সবগুলো নাও থাকতে পারে অথবা আলাদা রকমের কোনো বৈশিষ্ট্যও থাকতে পারে। সম্প্রদায়ের আবার নানান ধরন হয়। তবে সম্প্রদায় হতে গেলে একটি দলের সদস্যদের মধ্যে স্বকীয় পরিচয়ের বোধ, একাত্মতার বোধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতা থাকা খুব জরুরি।

আয়েশা বলল, সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে আমাদের ক্লাসেরও অনেক মিল আছে। তাহলে তো আমাদের ক্লাসটাও একটা সম্প্রদায়! শফিক বলল, আমার প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলে আমার যে সমাজ সেখানে ও সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য দেখতে পাচ্ছি। আনাই বলল, আমাদের বাড়ি খাগড়াছড়িতে। সেখানে আশপাশের সবার সঙ্গে আমার অনেক বেশি মিল— ভাষা, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, ধর্ম....। কিন্তু আমরা এখানে থাকি। এখানকার মানুষের সঙ্গেও অনেক বিষয়ে মিল খুঁজে পাই। তাহলে তো আমার দুটো প্রতিবেশী সম্প্রদায়। সুমন, জামাল, অন্বেষা, গণেশ আরও কিছু কথা বলল। তাতে দেখা গেল ওরা নিজেদের নানা রকমের সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখতে পাচ্ছে।

আমার সম্প্রদায়

খুশি আপা বললেন, আমরা একটা মজার খেলা খেলি চলো!

তালিকা থেকে পাওয়া সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যগুলো আলাদা আলাদা কাগজে লিখে শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন জায়গায় সাঁটিয়ে দেওয়া হলো।

এবারে খুশি আপা প্রতিবেশীদের নিয়ে তার যে সম্প্রদায়, সেটির যে বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে স্পষ্ট করে বোঝা যায়, প্রত্যেককে সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে বললেন।

সবাই বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর খুশি আপা হাততালি দিয়ে বললেন, বাহ! আমরা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যগুলো চমৎকারভাবে বুঝতে পেরেছি! নিজের সম্প্রদায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যকেও চিহ্নিত করতে পেরেছি।

নতুন পরিচয়

পরের ক্লাসে খুশি আপা একজন অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। তিনি বললেন, ইনি ছোটবেলায় তোমাদের স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। আজ এসেছেন, নিজের স্কুলটা দেখতে। সুমন জানতে চাইল, আপনার নাম কী? তিনি বললেন, আমার নাম শরীফা আকতার।

 

শরীফা

শরীফা বললেন, যখন আমি তোমাদের স্কুলে পড়তাম তখন আমার নাম ছিল শরীফ আহমেদ। আনুচিং অবাক হয়ে বলল, আপনি ছেলে থেকে মেয়ে হলেন কী করে? শরীফা বললেন, আমি তখনও যা ছিলাম এখনও তাই আছি। নামটা কেবল বদলেছি। ওরা শরীফার কথা যেন ঠিকঠাক বুঝতে পারল না।

আনাই তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোথায়? শরীফা বললেন, আমার বাড়ি এখান থেকে বেশ কাছে। কিন্তু আমি এখন দূরে থাকি। আনাই মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি, আমার পরিবার যেমন অন্য জায়গা থেকে এখানে এসেছে, আপনার পরিবারও তেমন এখান থেকে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছে। শরীফা বললেন, তা নয় । আমার পরিবার এখানেই আছে। আমি তাদের ছেড়ে দূরে গিয়ে অচেনা মানুষদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছি। এখন সেটাই আমার পরিবার। শরীফা নিজের জীবনের কথা বলতে শুরু করলেন।

শরীফার গল্প

ছোটবেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলত। কিন্তু আমি নিজে একসময়ে বুঝলাম, আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে। আমি মেয়েদের মতো পোশাক পরতে ভালোবাসতাম। কিন্তু বাড়ির কেউ আমাকে পছন্দের পোশাক কিনে দিতে রাজি হতো না। মায়ের সঙ্গে ঘরের কাজ করতে আমার | বেশি ভালো লাগত। বোনদের সাজবার জিনিস দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সাজতাম। ধরা পড়লে বকাঝকা, এমনকি মারও জুটত কপালে। মেয়েদের সঙ্গে খেলতেই আমার বেশি ইচ্ছে করত। কিন্তু মেয়েরা আমাকে | খেলায় নিতে চাইত না। ছেলেদের সঙ্গে খেলতে গেলেও তারা আমার কথাবার্তা, চালচলন নিয়ে হাসাহাসি | করত। স্কুলের সবাই, পাড়া-পড়শি এমনকি বাড়ির লোকজনও আমাকে ভীষণ অবহেলা করত। আমি কেন এ রকম একথা ভেবে আমার নিজেরও খুব কষ্ট হতো, নিজেকে ভীষণ একা লাগত ।

এক দিন এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো যাকে সমাজের সবাই মেয়ে বলে কিন্তু সে নিজেকে ছেলে বলেই মনে করে। আমার মনে হলো, এই মানুষটাও আমার মতন। সে আমাকে বলল, আমরা নারী বা পুরুষ নই, আমরা হলাম ‘ট্রান্সজেন্ডার’। সেই মানুষটা আমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল, যেখানে নারী- পুরুষের বাইরে আরও নানা রকমের মানুষ আছেন। তাদের বলা হয় ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠী। তাদের সবাইকে দেখেশুনে রাখেন তাদের ‘গুরু মা’। আমার সেখানে গিয়ে নিজেকে আর একলা লাগল না, মনে হলো না যে | আমি সবার চেয়ে আলাদা। সেই মানুষগুলোর কাছেই থেকে গেলাম। এখানকার নিয়ম-কানুন, ভাষা, রীতি- নীতি আমাদের বাড়ির চেয়ে অনেক আলাদা। তবু আমরা সবার সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়ে একটা পরিবারের | মতনই থাকি। বাড়ির লোকজনের জন্যও খুব মন খারাপ হয় কিন্তু তারা আমাকে আর চায় না, আশপাশের | লোকের কথায়ও তাদের ভীষণ ভয়।

আজ থেকে বিশ বছর আগে বাড়ি ছেড়েছি। সেই থেকে আমি আমার নতুন বাড়ির লোকদের সঙ্গে, নতুন শিশু আর নতুন বর-বউকে দোয়া-আশীর্বাদ করে পয়সা রোজগার করি। কখনও কখনও লোকের কাছে | চেয়ে টাকা সংগ্রহ করি। কিন্তু আমাদের ইচ্ছে করে সমাজের আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন কাটাতে, পড়াশোনা, চাকরি-ব্যবসা করতে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ আমাদের সঙ্গে মিশতে চায় না, | যোগ্যতা থাকলেও কাজ দিতে চায় না।

আমাদের মতো মানুষ পৃথিবীর সব দেশেই আছে। অনেক দেশেই তারা সমাজের বাকি মানুষের মতনই জীবন কাটায়। তবে আমাদের দেশের অবস্থারও বদল হচ্ছে। ২০১৩ সালে সরকার আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান আমাদের জন্য কাজ করছে। শিক্ষার ব্যবস্থা করছে, | কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর প্রচেষ্টা নিচ্ছে। নজরুল ইসলাম ঋতু, শাম্মী | রানী চৌধুরী, বিপুল বর্মণের মতো বাংলাদেশের অনেক ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ | সমাজজীবনে এবং পেশাগত জীবনে সাফল্য পেয়েছেন।

নতুন প্ৰশ্ন

ওরা এত দিন জানত, মানুষ ছেলে হয় অথবা মেয়ে হয়। এখানেও যে বৈচিত্র্য থাকতে পারে, সে কথা ওরা কখন শোনেনি, ভাবেওনি। কিন্তু শরীফা আলাদা রকম বলে সবাই তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, এমনকি তার পরিবারের লোকেরাও! শরীফার জীবন-কাহিনি শুনে সবার মন এমন বিষাদে ডুবে গেল যে তাকে আর বেশি প্রশ্ন করতেও ইচ্ছে করল না।

গণেশ, রনি, অন্বেষা, ওমেরা আর নীলা সেদিন বাড়ি ফেরার পথে গল্প করছিল:

গণেশ: তাহলে ছেলে এবং মেয়ে ছাড়াও ভিন্ন রকমের মানুষও হয়।

রনি: আমার মা বলেন, ছোটদের কোনো ছেলে-মেয়ে হয় না। বড় হতে হতে তারা ছেলে বা মেয়ে হয়ে ওঠে।

অন্বেষা: আমার জানতে ইচ্ছে করছে, আমাদের সময় ছেলে বা মেয়েদের পোশাক, আচরণ, কাজকর্ম যেমন | দেখি, প্রাচীন মানুষেরও কি তেমন ছিল? সামনের সময়েও কি এমনটা থাকবে?

রফিক: পৃথিবীর সব দেশে, সকল সম্প্রদায়ে কি ছেলে-মেয়ের ধারণা, তাদের চেহারা, আচরণ, সাজপোশাক একই রকম?

নীলা: আমার মা আমাকে বেগম রোকেয়ার লেখা একটা গল্প পড়ে শুনিয়েছিলেন। গল্পটার নাম ‘সুলতানার | স্বপ্ন'। সেখানে এমন একটা জায়গা কল্পনা করা হয়েছে যেখানে ছেলে আর মেয়েদের প্রচলিত ভূমিকা উল্টে গিয়েছে।

চলো, আমরাও নারী-পুরুষের ধারণা, সমাজে তাদের ভূমিকা আর নিজেদের ভাবনা সম্পর্কে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করি।

ছেলেদের জিনিস-মেয়েদের জিনিস

পরের দিনের ক্লাসে খুশি আপা টেবিলে কিছু খেলনা, সাজগোজের জিনিস আর পোশাকের ছবি রাখলেন। ক্লাসের সবাইকে ছেলেদের আর মেয়েদের দুটো দলে ভাগ হয়ে যেতে বললেন। তারপর বললেন, তোমরা এখান থেকে ছেলেদের আর মেয়েদের জিনিসের ছবিগুলো বেছে নাও ।

খুশি আপা দুটো দলের কাছেই জানতে চাইলেন, তোমরা ছেলেদের এবং মেয়েদের জিনিসগুলো ঠিকঠাক বেছে নিয়েছ তো? প্রতিটি দলই ‘হ্যাঁ' বলল। খুশি আপা বললেন, দুটো দলই স্কুলব্যাগ নিয়েছ দেখছি! কিন্তু একটা স্কুলব্যাগ নিয়ে টানাটানি করোনি। দুটো দল একদম আলাদা করে দুটো স্কুলব্যাগ পছন্দ করেছ। দলের মধ্যে কোনো মতবিরোধ হয়নি। এটা কেমন করে হলো? সুমন বলল, কারণ দুটো স্কুলব্যাগ দুই রঙের। একটা ছেলেদের রঙের আর একটা মেয়েদের রঙের। খুশি আপা প্রশ্নের ভঙ্গিতে তাকালেন। সালমা বুঝিয়ে বলল, ছেলেরা নীল রং পছন্দ করে তাই ওরা নীলটা নিয়েছে, আর মেয়েরা গোলাপি পছন্দ করে বলে আমরা গোলাপিটা নিয়েছি। খুশি আপা বললেন, আমার পছন্দের রং নীল। যে শাড়িটা পরে আছি, সেটাও নীল রঙের। তাহলে আমার পছন্দ ছেলেদের মতো বলছ? ওরা একটু থমকে গেল। সিয়াম আমতা আমতা করে বলল, না আপা। ঠিক তা নয়....

খুশি আপা বললেন, ক্লাসের মেয়ের দল কেউ ফুটবল, ক্রিকেট নিয়ে টানাটানি করল না, আপসেই ছেলেদের দিয়ে দিল! কেন? জামাল বলল, কারণ মেয়েরা এই খেলাগুলো খেলতে পছন্দ করে না। আনাই বলল, মোটেই না। বাংলাদেশের মেয়েরা খুব ভালো ক্রিকেট আর ফুটবল খেলছে। সারা পৃথিবীর মেয়েরাই খেলছে। বুশরা বলল, তাহলে তোরা এগুলো নিলি না কেন? সাবা বলল, ছেলেরা তো শেফ হয়, মেকআপ আর্টিস্টও হয়। তোরা তাহলে রান্নাবাটি আর মেকআপের খেলনা নিলি না কেন?

খুশি আপা তখন বললেন, কয়েকটা প্রশ্নের মাধ্যমে আমরা চিন্তার খোরাক পেতে পারি। ওরা সবাই মিলে নিচের প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করল।

* আমরা নিজেদের ছেলে এবং মেয়ে বলে আলাদা করে চিনি কীভাবে?

* ছেলে বা মেয়ে হিসেবে আমরা আমাদের পছন্দের পোশাক, রং, খেলনা, কাজগুলো কী নিজেরাই পছন্দ করি?

* ছেলেদের খেলনা-মেয়েদের খেলনা, ছেলেদের কাজ-মেয়েদের কাজ কীসের ভিত্তিকে নির্দিষ্ট করি?

একজন মানুষকে বাইরে থেকে দেখেই কি সব সময় সে ছেলে না মেয়ে তা বোঝা যায়?

* অন্যরা আমাদের সম্পর্কে কী ভাবছে তা আমাদের লিঙ্গগত পরিচয়কে কীভাবে প্রভাবিত করে?

* এমনটা কি হতে পারে যে, কাউকে আমরা তার শরীর বা চেহারা দেখে, গলার স্বর শুনে ছেলে বা মেয়ে বলে ভাবছি কিন্তু সে                নিজেকে ভিন্ন কিছু ভাবছে?

লিঙ্গ বৈচিত্র্য ও জেন্ডারের ধারণা

আলোচনা করতে করতে একসময়ে হাচ্চা বলল, আমার মনে হচ্ছে, আমরা যে মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখেই কাউকে ছেলে বা মেয়ে বলছি, সেটা হয়তো সবার ক্ষেত্রে সত্যি নয়। মামুন বলল, তাই তো! আমরা শরীফার জীবনের গল্প শুনলাম, যিনি দেখতে ছেলেদের মতন, কিন্তু মনে মনে তিনি একজন মেয়ে। তার কাছে এমন একজনের কথা জানলাম, যিনি দেখতে মেয়েদের মতো কিন্তু মনে মনে তিনি ছেলে।

খুশি আপা: আমরা চারপাশে দেখে এবং অন্যদের কাছে শুনে জেনেছি যে, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একটা নির্দিষ্ট ধরনের হলে সে ছেলে হয়, অন্য আরেকটা ধরনের হলে সে মানুষটা মেয়ে হয়। ছেলেদের গলার স্বর মোটা, মেয়েদের চিকন। মেয়েরা ঘরের কাজ বেশি করে, ছেলেরা বাইরে বেশি থাকে। মেয়েরা সাজগোজ করে, তাদের লজ্জা বেশি, তাদের মন নরম হয়। ছেলেরা সাজগোজ করে না, লজ্জা কম পায়, তারা কাঁদেও না । আমরা এগুলোকেই স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিচ্ছি।

ফাতেমা: কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, ছেলে-মেয়েদের চেহারা, আচরণ, কাজ বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের কোনো স্বত:সিদ্ধ নিয়ম নেই ।

খুশি আপা: ঠিক বলেছ!

সুমন: আমার মনে হচ্ছে, আমরা যেমন করে ভাবছি, অনেকেই তার চেয়ে ভিন্ন রকম করে ভাবে।

সাবা: কিন্তু সবার তো নিজের মত, নিজের অনুভূতি, নিজের পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশের স্বাধীনতা আছে!

খুশি আপা: যতক্ষণ না তাতে অন্যের কোনো ক্ষতি হচ্ছে, ততক্ষণ নিশ্চয়ই আছে।

শিহান: তাহলে শরীফা আপারা কার কী ক্ষতি করেছেন?

খুশি আপা: একটি শিশু যখন জন্ম নেয় তখন তার শরীর দেখে আমরা ঠিক করি সে নারী নাকি পুরুষ। এটি হলো তার জৈবিক লিঙ্গ পরিচয়। জৈবিক লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে একজন মানুষের কাছে সমাজ যে আচরণ প্রত্যাশা করে তাকে আমরা ‘জেন্ডার’ বা ‘সামাজিক লিঙ্গ' বলি। জৈবিক লিঙ্গ পরিচয়ের সঙ্গে তার জেন্ডার ভূমিকা না মিললে সমাজের প্রথাগত ধারণায় বিশ্বাসী মানুষেরা তাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।

হিজড়া জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়

কাজ শেষে গৌতম বলল, আচ্ছা আমাদের দেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষদের কি আমরা একটি ‘সম্প্রদায়’ বলতে পারি? খুশি আপা বললেন, আমরা সম্প্রদায়ের যে বৈশিষ্ট্যগুলো পেয়েছি সেগুলোর সঙ্গে এদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর মিল-অমিল পরীক্ষা করে দেখলেই বিষয়টা বুঝতে পারব।

খুশি আপা নিচের ছকটি বোর্ডে আঁকলেন। তারপর সবার সঙ্গে আলোচনা করে টিক চিহ্ন দিলেন।

হিজড়া জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য

সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যমিল আছেমিল নেই
একদল মানুষ  
স্বকীয়তার বোধ  
একাত্মতার বোধ  
   
   
   
   
   
   

কাজ শেষ করে দেখা গেল, সম্প্রদায়ের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং তারা সবাই মিলে বুঝতে পারল যে, বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীকে একটি সম্প্রদায় বলা যায়।

সালমা বলল, আমরা তো একটা চমৎকার ‘টুল’ তৈরি করে ফেলেছি! অরোরিন বলল, এই টুলটা ব্যবহার করে আমরা যে কোনো সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করতে পারব।

এবারে আমরাও আমাদের টুল ব্যবহার করে উপরের ছকটি পূরণ করি।

 

পেশাজীবী সম্প্রদায়

রূপা বলল, একটা দুর্গন্ধ পাচ্ছ? রনি বলল, স্কুলের পেছন দিক থেকে গন্ধটা আসছে। ফ্রান্সিস জানাল, বাজারের পাশেই একটা বড় ডাস্টবিন আছে। ওই পথে ওকে স্কুলে আসতে হয়। আজ আসার সময় দুর্গন্ধে ওর প্রায় বমি চলে এসেছিল। লোকজনকে বলাবলি করতে শুনেছে, দুদিন ধরে পরিচ্ছন্নতাকর্মী আসেনি। আরও দুদিন যদি তারা না আসে তাহলে বাজারে আর কেউ ঢুকতেই পারবে না। নীলা বলল, আমার চাচা একবার খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তখন দেখেছি, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর আসতে দেরি হয়েছে বলে অপারেশন করতেও অনেক দেরি হয়েছিল। মামুন বলল, পরিচ্ছন্নতাকর্মী কি অপারেশন করে নাকি? নীলা বলল, তা কেন! কিন্তু অপারেশন করার আগে অপারেশন থিয়েটার পরিষ্কার করতে হয়। মামুন বলল, তাই তো! হাসপাতাল শুনলেই মনে হয় সেখানে ডাক্তার আর নার্স খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তারা না এলে মানুষ চিকিৎসা সেবা পাবে না। কিন্তু হাসপাতালে রোগীর সেবায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীও তো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন! আদনান বলল, যদি পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কাজ করা বন্ধ করে দেয় তাহলে তো পৃথিবীর যত জায়গায় মানুষ আছে, সব জায়গাই নোংরায় ভরে যাবে।

খুশি আপা শ্রেণিকক্ষে আসার পর সবাই তাঁকে জানাল যে, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা যে সকলকে কত সাহায্য করেন, তা আজকের এই দুর্গন্ধের কারণে ওরা বুঝতে পেরেছে। খুশি আপা ওদের কথা শুনে আনন্দ প্রকাশ করলেন।

আনাই জানতে চাইল, আপা, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদেরও কি আমরা একটা সম্প্রদায় বলতে পারি? খুশি আপা বললেন, নিশ্চয়ই পারি। বংশানুক্রমে যারা সুনির্দিষ্ট পেশায় কাজ করে তাদের এক একটি আলাদা সম্প্রদায় তৈরি হয়। আমাদের দেশে হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষরা সাধারণত পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করে। যাদের নিজস্ব ভাষা, স্বতন্ত্র জীবনধারা আছে। আবার পেশা বংশানুক্রমিক না হলেও পেশার ভিত্তিতে এক একটি পেশাজীবী সম্প্রদায় তৈরি হয়। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য পেশাজীবী সম্প্রদায়ও কিন্তু আমাদের সাহায্য করেন।

চলো আমরা প্রত্যেকে টুল ব্যবহার করে আমাদের আশপাশের পেশাজীবী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করি। কাজটি আমরা অনুসন্ধানী কাজের ধাপ অনুসরণ করে করব। এরপর ওরা তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রশ্ন তৈরি করল, তারপর তথ্য সংগ্রহ করে, বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে ফলাফল উপস্থাপন করল।

আমরাও ওদের মতো করে আমাদের টুল ব্যবহার করে, অনুসন্ধানী কাজের মাধ্যমে আমাদের আশপাশের পেশাজীবী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করে শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করি।

 

বিশ্বের অন্যান্য দেশের পেশাজীবী সম্প্রদায়

খুশি আপা বললেন, আমাদের দেশের বিভিন্ন পেশাজীবী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যগুলো তো খুঁজে বের করলাম, এবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের পেশাজীবী সম্প্রদায়গুলোর বৈশিষ্ট্যও ইন্টারনেট, বই, পত্রিকা ইত্যাদির সাহায্য নিয়ে খুঁজে বের করি। আমাদের পরিবারের, আশপাশের বা পরিচিত কেউ বিদেশে থাকলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও তথ্য সংগ্রহ করতে পারি।

ওরা এবারও নিজেদের তৈরি টুল ব্যবহার করে, অনুসন্ধানী কাজের ধাপ অনুসরণ করে তথ্য উপস্থাপন করল। 

চলো, আমরাও আমাদের টুল ব্যবহার করে, অনুসন্ধানী কাজের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের পেশাজীবী | সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করে শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করি।

পারস্পরিক সহযোগিতা

খুশি আপা শিহানকে বললেন, তুমি কি আমাকে ওই কলমটা একটু দেবে? শিহান খুশি আপাকে কলমটা দেওয়ার পর খুশি আপা তাকে ধন্যবাদ জানালেন। তারপর সবাইকে বললেন, শিহান আমাকে সাহায্য করেছে বলে আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। অর্থাৎ কেউ আমাদের সাহায্য করলে বিনিময়ে আমরাও কিছু করি। এরপর তিনি জানতে চাইলেন, আমরা তো পেশাজীবী সম্প্রদায়কে নিয়ে অনেক কাজ করলাম, আমাদের চারপাশে যেসব পেশাজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন, যারা নানাভাবে সমাজের সেবা করেন, আমাদের প্রয়োজনে কাজ করেন, তাদের অবদান আমরা কি বুঝতে পারি? আয়েশা বলল, পারি। খুশি আপা বললেন, চমৎকার! তাহলে চলো, এই ছকটা ব্যবহার করে ছোট্ট একটা পরীক্ষা করি। আমরা প্রত্যেকে এই ছকটা পূরণ করব।

আমার আশপাশের পেশাজীবীআমি তার কাছে যে সাহায্য পাইআমি তাকে যেভাবে সাহায্য করি
১.  
২.  
৩.  
৪.  
৫.  
   
   

আমরাও ছক পূরণের কাজটি করি।

ছক পূরণ করতে গিয়ে কেউ কেউ জানতে চাইল, ‘আমি তাকে যেভাবে সাহায্য করি’ এই ঘরটায় কী লিখব? সালমা বলল, আজ সকালে আমি রিকশায় চড়ে স্কুলে এসেছি। রিকশাওয়ালা আমাকে পৌঁছে দিয়েছেন, বিনিময়ে আমি তাকে টাকা দিয়েছি। আমি কি সেটাই লিখব? তখন ক্লাসের অন্যান্যরাও বলল, তারাও বিভিন্ন সেবার বিনিময়ে পেশাজীবীদের টাকা দেয়।

খুশি আপা: সেবার মূল্য কি কেবল টাকা দিয়ে পরিশোধ করা যায়? ধরো, আজ সকালে সালমা যদি একটাও রিকশা না পেত, তাহলে ও কী করত? অথবা যদি সেই রিকশাওয়ালা ওকে পৌঁছে দিতে রাজি না হতো, তাহলে টাকা ওর কী কাজে লাগত?

রনি: আমরা তাহলে সেবার বিনিময়ে টাকা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ধন্যবাদও জানাতে পারি। 

খুশি আপা: নিশ্চয়ই পারি। 

নীলা: আমাদের বাড়িতে যিনি কাজে সাহায্য করেন, তার মেয়েকে আমি আমার একটা জামা দিয়েছিলাম। 

রূপা: বাড়ির অদরকারি জিনিসপত্র আমরা যাদের দরকার তাদের দিই। 

মাহবুব: আমার বাবা-মা অনেককে অনেক সাহায্য করেন। 

বুশরা: কিন্তু কেউ আমাকে সাহায্য করছেন, তার জন্যও আমার কিছু করার আছে, এভাবে কখনও ভেবে দেখিনি। অথচ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সাহায্য ছাড়া আমরা চলতে পারি না! 

খুশি আপা: জীবন যাপনের জন্য দরকারি সব কাজ একা কেউ করতে পারে না। সকল সম্প্রদায়ের মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতায় সমাজ টিকে থাকে।

আমরা যাদের কাছ থেকে সাহায্য নিচ্ছি, তাদের জন্য আমদের কী করণীয়, চলো ভেবে বের করি এবং তালিকা তৈরি করি। কাজটি আমরা সক্রিয় নাগরিক ক্লাবের মাধ্যমে বছরব্যাপী করব এবং নিজেদের আচরণেও প্রয়োগ করব। তালিকা থেকে দলে করানোর জন্য আমরা কিছু কাজ বেছে নেব, আর কিছু কাজ এককভাবে করব।

ওরা সক্রিয় নাগরিক ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সদস্যদের সহযোগিতা করার জন্য সম্ভাব্য কাজের একটি তালিকা তৈরি করল:

     * পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের এক দিন বিশ্রাম করতে দিয়ে সপ্তাহে এক দিন বিদ্যালয় পরিচ্ছন্ন করা

     * কৃষকদের আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, জৈব সার, প্রাকৃতিক কীটনাশক সম্পর্কে জানানো

     * দরিদ্র শিশুদের লেখাপড়ায় সাহায্য করা, নতুন বা পুরোনো বই, শিক্ষা উপকরণ, খেলনা ইত্যাদি দেওয়া

     * আশপাশের সম্প্রদায়ের বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে গল্প করা, তাদের বই, পত্রিকা পড়ে শোনানো

     * ব্যাংকে জমানো টাকা দিয়ে শীতবস্ত্র দেওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়া

এরপর ওরা দলীয় এবং একক কাজের হিসাব রাখার জন্য একটা ছক তৈরি করল।

দলীয় কাজপ্রত্যক্ষ       
       
একক কাজপরোক্ষ       
       

ওরা তালিকা অনুযায়ী বছরব্যাপী আশপাশের পেশাজীবী সম্প্রদায়ের মানুষদের সহযোগিতা করল এবং তা ছকে লিখে রাখল। বছর শেষে ওদের কাজগুলোর মূল্যায়ন হলো।

চলো, আমরাও সক্রিয় নাগরিক ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সদস্যদের | সহযোগিতা করার জন্য সম্ভাব্য কাজের একটি তালিকা তৈরি করি। দলীয় এবং একক কাজের হিসাব | রাখার জন্য একটা ছক তৈরি করে তাতে আমাদের কাজগুলোর কথা লিখে রাখি।

common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion